• যে সমস্ত মহর্ষিরা নারদ মুনিকে পারমার্থিক তত্ত্বজ্ঞান দান করেছিলেন, তাঁরা দূর দেশে যখন গমন করেছিলেন, তখন নারদ মুনির বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর।
  • নারদ মুনি ছিলেন দাসী-পুত্র। তাঁর স্নেহময়ী মাতা তাঁকে যথাযথভাবে পালন করতে চাইতেন, কিন্তু যেহেতু তিনি স্বতন্ত্র ছিলেন না, তাই তিনি তাঁর জন্য কিছুই করতে পারতেন না।
  • এক সময়ে তাঁর অভাগিনী মা যখন রাত্রিবেলা গো-দোহন করতে যাচ্ছিলেন, তখন মহাকালের প্রভাবে তাঁর পায়ের দ্বারা আহত একটি সর্প তাঁকে দংশন করে।
  • সেই ঘটনাটিকে তিনি ভক্তবৎসল ভগবানের বিশেষ কৃপা বলে মনে করে উত্তর দিকে যাত্রা করলেন। গৃহত্যাগ করার পর তিনি বহু সমৃদ্ধশালী জনপদ, নগর, গ্রাম, গোচারণ ভূমি, খনি, ক্ষেত, উপত্যকা, বাগান, উপবন এবং বন অতিক্রম করেছিলেন।
  • তিনি স্বর্ণ, রৌপ্য এবং তাম্র আদি ধাতুতে পূর্ণ পাহাড় এবং পর্বত অতিক্রম করেছিলেন, এবং সুন্দর পদ্মফুলে সুশোভিত, বিভ্রান্ত ভ্রমর এবং সঙ্গীতমুখর পাখিদের দ্বারা অলঙ্কৃত স্বর্গের দেবতাদের উপযুক্ত জলাশয় এবং স্থল্ভূমি অতিক্রম করেছিলেন।
  • তারপর তিনি নল, বাঁশ, শর, কুশ, লতাগুল্ম ইত্যাদিতে পূর্ণ অত্যন্ত দুর্গম অরণ্যানী একাকী অতিক্রম করেছিলেন। তিনি ভয়ঙ্কর অন্ধকারাচ্ছন্ন বিপদসঙ্কুল বনের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন, যা ছিল সর্প, পেচক এবং শৃগালদের বিচরণক্ষেত্র।
  • এইভাবে ভ্রমণ করে তিনি দৈহিক এবং মানসিক উভয় দিক দিয়েই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন, এবং তিনি তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত হয়েছিলেন। তখন নদীতে ও হ্রদে স্নান করে এবং সেখানকার জল পান করে ও স্পর্শ করে তিনি তাঁর শ্রান্তি দূর করেছিলেন।

  • তারপর, জনমানবশূণ্য এক অরণ্যে একটি অশ্বত্থ বৃক্ষের নিচে উপবেশন করে তিনি তাঁর বুদ্ধির দ্বারা মুক্ত পুরুষদের কাছ থেকে ঠিক যেভাবে শ্রবণ করেছিলেন, সেই বর্ণনা অনুসারে তাঁর অন্তরের অন্তঃস্থলে বিরাজমান পরমাত্মার ধ্যান করতে শুরু করেছিলেন।
  • তিনি যখন তাঁর হৃদয়ে পরমেশ্বর ভগবানের চরণারবিন্দের ধ্যান করতে শুরু করেছিলেন, তখন তাঁর চিত্তে এক অপ্রাকৃত ভাবের উদয় হয়েছিল, তাঁর চক্ষুদ্বয় অশ্রুপ্লাবিত হয়েছিল এবং অচিরেই, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরি তাঁর হৃদয়কমলে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
  • সেই সময় প্রবল আনন্দের অনুভূতিতে অভিভূত হয়ে পড়ার ফলে তাঁর দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পুলকিত হয়েছিল। আনন্দের সমুদ্রে নিমগ্ন হয়ে তিনি সেই মুহূর্তে ভগবানকে এবং নিজেকেও দর্শন করতে পারছিলেন না।
  • ভগবানের অপ্রাকৃত রূপ যথাযথভাবে মনের বাসনা পূর্ণ করে এবং সব রকমের মানসিক বৈষম্য দূর করে। তাঁর সেই রূপ দর্শন করতে না পেরে, অত্যন্ত প্রিয় বস্তু হারালে মানুষ যেভাবে বিচলিত হয়ে পড়ে, সেইভাবে বিচলিত হয়ে তিনি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়েছিলেন।
  • ভগবান তাঁকে বললেন, “হে নারদ, এই জীবনে তুমি আর আমাকে দর্শন করতে পারবে না। যাদের সেবা পূর্ণ হয়নি এবং যারা সব রকমের জড় কলুষ থেকে  সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হতে পারেননি, তারা আমাকে কদাচিৎ দর্শন করতে পারে।  হে নিষ্পাপ, তুমি কেবল একবার মাত্র আমার রূপ দর্শন করেছ এবং তা কেবল আমার প্রতি তোমার আসক্তি বৃদ্ধি করার জন্য; কেন না তুমি যতই আমাকে লাভ করার জন্য লালায়িত হবে, ততই তুমি সমস্ত জড় কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত হবে। অল্পকালের জন্যও যদি ভগবদ্ভক্ত-সাধু-সেবা করা হয়, তা হলে আমার প্রতি সুদৃঢ় মতি উৎপন্ন হয়। তার ফলে সে দুঃখদায়ক এই জড় জগত ত্যাগ করার পর আমার অপ্রাকৃত ধামে আমার পার্ষদত্ব লাভ করে। সৃষ্টির সময় এমন কি প্রলয়ের সময়েও আমার কৃপায় তোমার স্মৃতি অপ্রতিহত থাকবে। “
  • গভীর কৃতজ্ঞতা অনুভব করে নারদ মুনি নত মস্তকে ভগবানকে প্রণতি নিবেদন করেছিলেন।
  • এইভাবে সব রকম সামাজিক লৌকিকতা উপেক্ষা করে তিনি ভগবানের দিব্য নাম এবং মহিমা নিরন্তর কীর্তন করতে শুরু করলেন এবং সর্বতোভাবে তৃপ্ত হয়ে বিণীত ও নির্মৎসর চিত্তে সমস্ত পৃথিবী পর্যটন করতে থাকলেন।
  • সব রকমের জড় কলুষ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গ করার উপযুক্ত একটি চিন্ময় শরীর লাভ করে তিনি পঞ্চভৌতিক দেহটি ত্যাগ করেন এবং তার ফলে তাঁর সমস্ত কর্মফল নিবৃত্ত হয়।
  • কল্পান্তে যখন পরমেশ্বর ভগবান নারায়ণ কারণ বারিতে শয়ন করলেন, ব্রহ্মা তখন সৃষ্টির সমস্ত উপাদানগুলি নিয়ে তাঁর মধ্যে প্রবেশ করলেন, এবং তিনিও তখন তাঁর নিঃশ্বাসের মাধ্যমে তাঁর মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন।
  • ৪৩০,০০,০০,০০০ সৌর বৎসর পর ব্রহ্মা যখন ভগবানের ইচ্ছা অনুসারে পুনরায় সৃষ্টি করার জন্য মরীচি, অঙ্গিরা, অত্রি আদি ঋষিদের তাঁর দিব্য দেহ থেকে সৃষ্টি করেন, তখন তাঁদের সঙ্গে নারদ মুনিও আবির্ভূত হয়েছিলেন।
  • তখন থেকে সর্বশক্তিমান বিষ্ণুর কৃপায় তিনি অপ্রাকৃত জগতে এবং জড় জগতের ত্রিভুবনে অপ্রতিহতভাবে সর্বত্র ভ্রমণ করছেন।
  • এইভাবে তিনি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক প্রদত্ত বীণা বাজিয়ে স্বরব্রহ্ম বিভূষিত ভগবানের মহিমা নিরন্তর কীর্তন করেন।

জয় নারদ মুনি!