- ত্রেতা এবং দ্বাপরের যুগপর্যায়ে বসু-দুহিতা সত্যবতীর গর্ভে পরাশর মুনির পুত্ররূপে ব্যাসদেবের জন্ম হয়।
- তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন দ্বাপরের তৃতীয় সন্ধ্যায়। (প্রতিটি যুগ তিনটি ভাগে বিভক্ত এবং সেই প্রতিটি ভাগকে বলা হয় ‘সন্ধ্যা’)
- একসময়ে তিনি সূর্যোদয়ের সময় সরস্বতী নদীর জলে প্রাতঃস্নান করে বদরিকাশ্রমের শম্যাপ্রাস নামক স্থানে একাকী উপবিষ্ট হয়ে ধ্যানস্থ হলেন।
- পূর্ণ জ্ঞানসম্পন্ন মহর্ষি তাঁর দিব্য দৃষ্টির দ্বারা কলিযুগের প্রভাবে জড় জগতের অধঃপতন দর্শন করলেন। তিনি দেখলেন যে, কলিযুগের শ্রদ্ধাহীন জনসাধারণের আয়ু অত্যন্ত হ্রাস পাবে এবং সত্ত্বগুণের অভাবে তারা ধৈর্যহীন হয়ে পড়বে। তাই তিনি সমস্ত বর্ণ ও আশ্রমের মানুষের কিভাবে মঙ্গলসাধন করা যায় সেই চিন্তা করলেন।
- তিনি দেখলেন যে, বেদে নির্দেশিত যজ্ঞ-অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের বৃত্তি অনুসারে তার কার্যকলাপকে পবিত্র করা। এই প্রক্রিয়াকে সরলীকৃত করার উদ্দেশ্যে তিনি এক বেদকে চার ভাগে বিভক্ত করেছিলেন, মানুষের মধ্যে তা বিস্তার করার জন্য।
- জ্ঞানের আদি উৎস বেদকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। ঐতিহাসিক তথ্য এবং পুরাণে উল্লিখিত সত্য ঘটনার বর্ণনাগুলিকে পঞ্চম বেদ বলা হয়।
- বেদকে চারটি ভাগে ভাগ করার পর পৈল ঋষি হলেন ঋকবেদের অধ্যাপক, জৈমিনি হলেন সামবেদের অধ্যাপক, বৈশম্পায়ন যজুর্বেদের দ্বারা মহিমান্বিত হলেন এবং অঙ্গিরা ঋষিকে (সুমন্ত মুনি নামেও পরিচিত) অথর্ব বেদ দান করা হয়েছিল। রোমহর্ষণ ঋষির হাতে পুরাণ এবং ঐতিহাসিক তথ্যসমূহ অর্পণ করা হয়েছিল।
- সেই সমস্ত তত্ত্বদ্রষ্টা ঋষিরা বিভিন্ন বেদকে তাঁদের শিষ্য, প্রশিষ্য এবং প্রশিষ্যের শিষ্যদের প্রদান করেছিলেন এবং এইভাবে গুরু-শিষ্য-পরম্পরায় অনন্ত শাখায় বেদ-অনুশীলন শুরু হয়।
- এইভাবে অজ্ঞানীদের প্রতি অত্যন্ত কৃপালু মহর্ষি বেদব্যাস বেদ সংকলন করেন, যাতে অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে।
- স্ত্রী, শূদ্র এবং দ্বিজোচিত গুণাবলীবিহীন ব্রাহ্মণ কুলোদ্ভূত মানুষদের বেদের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা নেই, তাই তাদের প্রতি কৃপাপরবশ হয়ে মহর্ষি বেদব্যাস মহাভারত নামক ইতিহাস রচনা করলেন, যাতে তারা তাদের জীবনের পরম উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পারে।
- যদিও তিনি সমস্ত মানুষের সর্বাঙ্গীন কল্যাণ সাধনে সচেষ্ট হয়েছিলেন, তবুও তাঁর চিত্ত সন্তুষ্ট ছিল না। হৃদয়ে অপ্রসন্ন হয়ে তিনি তৎক্ষনাৎগভীরভাবে বিচার করতে শুরু করলেন। “আমি যে বিশেষভাবে ভগবদ্ভক্তি বর্ণনা করিনি, যা পরমহংসদের এবং অচ্যুত পরমেশ্বর ভগবানের অত্যন্ত প্রিয়, তাই হয়ত আমার এই অসন্তোষের কারণ।”
- ব্যাসদেব যখন তাঁর অসন্তোষের জন্য অনুশোচনা করছিলেন তখন নারদ মুনি সরস্বতী নদীর তীরে তাঁর আশ্রমে এসে উপস্থিত হলেন।
- শ্রীনারদ মুনির শুভাগমনে শ্রীল ব্যাসদেব শ্রদ্ধা সহকারে উঠে দাঁড়িয়ে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে যেভাবে সম্মান প্রদর্শন করা হয়, সেইভাবে তাঁকে অভ্যর্থনা করলেন।
- দেবর্ষি নারদ তখন সুখে উপবিষ্ট হয়ে স্মিত হেসে বিপ্রর্ষিকে (বেদব্যাসকে) বললেন, “তোমার প্রশ্নগুলি ছিল পূর্ণ এবং তোমার অধ্যয়নও যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়েছে, আর তুমি যে সমস্ত বৈদিক নির্দেশ বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করে মহৎ এবং অদ্ভুত মহাভারত রচনা করেছো সে সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তুমি পরমেশ্বর ভগবানের অত্যন্ত মহিমান্বিত এবং নির্মল কীর্তি যথাযথভাবে কীর্তন করনি। যে দর্শন পরমেশ্বর ভগবানের অপ্রাকৃত ইন্দ্রিয়গুলির সন্তুষ্টিবিধান করে না, তা অর্থহীন। যে বাণী জগৎ পবিত্রকারী ভগবানের মহিমা বর্ণনা করে না, তাকে সন্ত পুরুষেরা কাকেদের তীর্থ বলে বিবেচনা করেন। ভগবদ্ধামে নিবাসকারী পরমহংসরা সেখানে কোন রকম আনন্দ অনুভব করেন না। পক্ষান্তরে যে সাহিত্য ভগবানের নাম, রূপ, যশ, লীলা ইত্যাদির বর্ণনায় পূর্ণ, তা দিব্য শব্দ-তরঙ্গে পরিপূর্ণ এক অপূর্ব সৃষ্টি, যা এই জগতের উদ্ভ্রান্ত জনসাধারণের পাপ-পঙ্কিল জীবনে এক বিপ্লবের সূচনা করে। এই অপ্রাকৃত সাহিত্য যদি নির্ভুলভাবে রচিত নাও হয়, তবুও তা সৎ এবং নির্মল চিত্ত সাধুরা শ্রবণ করেন, কীর্তন করেন এবং গ্রহণ করেন।”
- নারদ আরও বললেন, “ভগবানকে ছাড়া তুমি আর যা কিছু বর্ণনা করতে চাও, তা সবই বিভিন্ন রূপ, নাম এবং পরিণামরূপে মানুষের চিত্তকে উদ্বিগ্ন এবং উত্তেজিত করবে, ঠিক যেভাবে একটি আশ্রয়বিহীন নৌকা বায়ুর দ্বারা তাড়িত হয়ে ইতিস্তত বিক্ষিপ্ত হয়। পরমেশ্বর ভগবান অসীম। জড় সুখভোগের বাসনা থেকে বিরত, অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তিরাই কেবল এই পারমার্থিক তত্ত্বজ্ঞান উপলব্ধি করার যোগ্য। তাই যারা জড় বিষয়াসক্তির ফলে এই স্তরে অধিষ্ঠিত হতে পারেনি, তোমার মতো মহৎ আশয়সম্পন্ন ব্যক্তির কর্তব্য হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের অপ্রাকৃত লীলাবিলাসের কাহিণী বর্ণনা করার মাধ্যমে তাদের পথ-প্রদর্শন করা। তুমি পূর্ণদ্রষ্টা। তুমি আত্মার দ্বারা অন্তর্যামী পরমেশ্বর ভগবানকে জানতে পার, কেন না তুমি ভগবানের কলা-অবতার। যদিও তুমি জন্মহীন, তবুও সমস্ত মানুষের মঙ্গল সাধনের জন্য তুমি এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছ। তাই দয়া করে তুমি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিব্য লীলাসমূহ অত্যন্ত উজ্জ্বলভাবে বর্ণনা কর।”
- নারদ মুনি ব্যাসদেবকে উপদেশ প্রদান করে অন্তর্হিত হলেন। তারপর ব্যাসদেব সাধারণ মানুষের জাগতিক দুঃখ-দুর্দশা উপশমের জন্য এবং জীবেদের কল্যাণের জন্য পরম-তত্ত্ব সমন্বিত সাত্বত সংহিতা শ্রীমদ্ভাগবত সংকলন করেছেন।
- শ্রীমদ্ভাগবত রচনা করার পর মহর্ষি বেদব্যাস পুনর্বিচারপূর্বক তা সংশোধন করেন এবং তা তাঁর পুত্র শ্রীশুকদেব গোস্বামীকে শিক্ষা প্রদান করেন।
(শ্রীমদ্ভাগবত, ১.৪.১৪-১.৭.৮)
জয় শ্রীমদ্ভাগবতম্!
Leave A Comment