আত্মোপলব্ধির দ্বারা কেউ যখন হৃদয়ঙ্গম করতে পারে যে স্থূল এবং সূক্ষ্ম শরীরের সঙ্গে শুদ্ধ আত্মার কোন সম্পর্ক নেই, তখন সে নিজেকে এবং পরমেশ্বর ভগবানকে দর্শন করে। (শ্রীমদ্ভাগবত, ১.৩.৩৩)

আত্মোপলব্ধি এবং জড় ভ্রমের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, আত্মার বাহ্য আবরণরূপ স্থূল এবং সূক্ষ্ম শরীরকে জড়া প্রকৃতি কৃত অনিত্য এবং ভ্রমাত্মক বলে জানা। এই আবরণেরর কারণ হচ্ছে অজ্ঞান। পরমেশ্বর ভগবান কখনও এই জাতীয় আবরণের দ্বারা প্রভাবিত হন না। সেটি স্থির নিশ্চিতরূপে জানার নামই হচ্ছে মুক্তি, অথবা ভগবৎ-দর্শন। অর্থাৎ, দিব্য বা পারমার্থিক জীবন-যাপন করার ফলেই কেবল আত্মোপলব্ধি সম্ভব। আত্মোপলব্ধি মানে হচ্ছে স্থূল এবং সূক্ষ্ম শরীরের প্রয়োজনগুলির প্রতি উদাসীন হওয়া এবং আত্মার কার্যকলাপে নিষ্ঠাপরায়ণ হওয়া। কোন কিছু করার অণুপ্রেরণা আসে আত্মা থেকে, কিন্তু সমস্ত কার্যকলাপ ভ্রমাত্মক হয়ে পড়ে আত্মার যথার্থ অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞতার ফলে। অজ্ঞানের ফলে জীব স্থূল এবং সূক্ষ্ম দেহের পরিপ্রেক্ষিতে তার আত্মার মঙ্গল সাধনের হিসাব-নিকাশ করে, এবং তার ফলে জন্ম-জন্মান্তরে তার সমস্ত কার্যকলাপ বিফল হয়। কিন্তু যথার্থ অনুশীলনের মাধ্যমে কেউ যখন আত্মাকে জানতে পারে, তখনই আত্মার কার্যকলাপ শুরু হয়। তাই যে মানুষ আত্মার কার্যকলাপে যুক্ত, তাঁকে বলা হয় জীবন্মুক্ত, অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে বদ্ধ অবস্থায় থাকলেও তিনি মুক্ত।

আত্মোপললব্ধির এই পূর্ণ স্তর কখনও কৃত্রিম সাধনের মাধ্যমে লাভ করা যায় না, তা লাভ হয় পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় গ্রহণ করার ফলে। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান বলেছেন যে, তিনি সকলেরই হৃদয়ে বিরাজ করছেন এবং সমস্ত জ্ঞান, স্মৃতি, অথবা বিস্মৃতি তাঁর থেকেই আসে। জীব যখন জড় জগতকে ভোগ করার ভ্রান্ত প্রয়াস করে, তখন ভগবান জীবকে বিস্মৃতির আবরণে আচ্ছাদিত করেন, এবং জীব তখন তার স্থূল দেহকে এবং সূক্ষ্ম মনকে তার স্বরূপ বলে মনে করে। কিন্তু পারমার্থিক জ্ঞান অনুশীলন করার ফলে জীব যখন বিস্মৃতির কবল থেকে মুক্ত হবার জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে, ভগবান তখন তাঁর অহৈতুকী কৃপার প্রভাবে সেই জীবের মায়া-যবনিকা উত্তোলন করেন এবং তার ফলে সে নিজেকে চিনতে পারে। সে তখন তার নিত্য স্বরূপে ভগবানের সেবায় যুক্ত হয় এবং বদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত হয়। এই সমস্ত কার্য ভগবান তাঁর বহিরঙ্গা শক্তির দ্বারা অথবা সরাসরিভাবে তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তির দ্বারা সম্পাদন করেন।

হরে কৃষ্ণ!