তিনি অভয়চরণ

সন্ন্যাসজীবনে স্বামী প্রভুপাদ। পঞ্চাশ বছর আগে মালবাহী জাহাজে চেপে শুরু হয় সাগরপারে তাঁর ধর্ম-অভিযান। সম্বল মাত্র আট ডলার। লিখছেন শংকর। আজ প্রথম কিস্তি

Anandabazarআনন্দবাজার পত্রিকায় শ্রীল প্রভুপাদের মহিমাপ্রকাশ: https://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/life-history-philosophy-and-work-of-swami-prabhupada-the-founder-of-iskon-1.191699

পরপদানত দারিদ্র ভারে নতশির ভারতবর্ষ বিগত উনিশ ও বিশ শতকে পশ্চিমি সভ্যতাকে কী দিতে পেরেছে তার হিসেব কষতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে অধ্যাত্মজ্ঞান, সঙ্গীতরস, সাহিত্যসুধা ও নৃত্যকলা ছাড়া আর কোনও বিষয়েই আমরা আমেরিকা-ইউরোপের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারিনি।
অধ্যাত্মবাদীর বাইরে যে ক’টি এক্সপোর্ট কোয়ালিটি নাম আমাদের সঞ্চয়ের মধ্যে রয়েছেন তাঁরা অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উদয়শঙ্কর এবং রবিশঙ্কর। ভাবতে ভাল লাগে এঁরা সবাই বাঙালি।

আর অধ্যাত্মবাণী প্রচারের সঙ্গে যাঁরা বিস্ময়কর ভাবে জড়িত তাঁরা সবাই যে বঙ্গসরস্বতীর বরপুত্র তা ভাবতে আরও আশ্চর্য লাগে। এই ক্ষুদ্র তালিকাটি একটু ঝালিয়ে নেওয়া যেতে পারে।

প্রথম নামটি কলকাতার রমণীমোহন চট্টোপাধ্যায়। এক সময় আমেরিকায় বেদ প্রচারে ছোটখাট আলোড়ন তুলেছিলেন, তারপর স্বদেশে ফিরে এসে ঠাকুরবাড়ির দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই জামাই কলকাতার  অ্যাটর্নি প্রফেশনে স্বনামধন্য হন। তাঁর জন্ম ১৮৫৮, দেহাবসান ১৯৩৬।
দ্বিতীয় জন প্রতাপচন্দ্র মজুমদার মোহিনীমোহনের থেকে প্রায় কুড়ি বছরের বড়, ব্রাক্ষ্মবাণী প্রচারের দুঃসাহসে আমেরিকায় যান এবং পরে ১৮৯৩ সালে শিকাগো ধর্মমহাসম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন, যেখানে কলকাতার অনাহূত বক্তা রামকৃষ্ণশিষ্য নরেন্দ্রনাথ দত্ত যে আলোড়ন ফেলে দেন তা ভারতবর্ষ আজও ভুলতে পারেনি। রামকৃষ্ণ মিশনের বিশ্বব্যাপী জয়যাত্রা উনিশ শতকের মস্ত বড় এক ঘটনা। স্বামী বিবেকানন্দ দীর্ঘজীবন লাভ করেননি, কিন্তু একজন দূরদর্শী ম্যানেজমেন্ট বিশারদ হিসেবে চারজন রামকৃষ্ণ শিষ্যকে আমেরিকায় পাঠিয়েছিলেন।  স্বামী সারদানন্দ (১৮৬৫-১৯২৭), স্বামী অভেদানন্দ (১৮৬৬-১৯৩৯), স্বামী তুরীয়ানন্দ (১৮৬৩-১৯২১) ও স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ (১৮৬৫-১৯১৫)। এঁরা সকলেই কলকাতার ছেলে। শেষোক্ত জন আমেরিকায় বেদান্ত প্রচারকালেই ২৭ ডিসেম্বর ১৯১৪ বোমার আঘাতে আহত হয়ে কয়েক দিন পরে নতুন বছরে মারা যান। আরও আশ্চর্য, আরও একজন বাঙালি পরবর্তী সময়ে আমেরিকায় বিপুল সম্মান ও স্বীকৃতি অর্জন করেছিলেন, তাঁর আদি নাম মুকুন্দলাল ঘোষ, পরবর্তী কালে পরমহংস যোগানন্দ, বাইশ বছর বয়সে সন্ন্যাস নিয়ে সাতাশ বছর বয়সে (১৯২০) জাহাজযোগে আমেরিকায় যান এবং ভারতীয় প্রচারকদের মধ্যে দীর্ঘতম সময় (১৯২০-৫২) প্রবাসে কাটিয়ে ওদেশেই দেহরক্ষা করেন। তাঁর যোগদা সৎসঙ্গ আজও বিশ্বের নানা অংশে প্রাণবন্ত হয়ে আছে। এঁর আত্মজীবনী ‘অটোবায়োগ্রাফি অব এ যোগী’ আজও লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়।

এখানেই শেষ নয়, ১৯৪৭ সালের পর আরও দুটি বাঙালি নাম আটলান্টিকের ওপারে বিস্ময়কর সাফল্যের নিদর্শন। একজন সি কে ঘোষ প্রথম পর্বে চট্টগ্রাম থেকে পুদুচেরীর অরবিন্দ আশ্রমে এবং সেখান থেকে অন্তরের আদেশে মাত্র আট ডলার পকেটে নিয়ে বঙ্গীয় সাধকদের এই ধারাবাহিক বিশ্ববিজয় কাহিনি আজও তেমনভাবে কেন আমাদের গর্বের এবং আত্মবিশ্বাসের কারণ হয়ে ওঠেনি তা ঠিক বুঝতে পারি না। বিশেষ করে শেষজনের কথা আজও তেমনভাবে বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠেনি আজও, যদিও আটলান্টিকের ওপারে তাঁর বিপুল সম্মান ও স্বীকৃতি স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতবর্ষের এক তুলনাহীন গর্বের কাহিনি।

এই মানুষটি সম্বন্ধে কানাঘুষো অনেক দিন, কিন্তু তাঁর মহামূল্যবান বাণীগুলি শত সহস্র শ্বেতাঙ্গের হৃদয়স্পন্দন ঘটালেও আমরা আজও তাঁকে তেমনভাবে জানি না। ভারতবাণী পৃথিবীর দিকে দিকে প্রচারে তাঁর সাফল্য যে শতাব্দীর সেরা তাও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির ভাবনা-চিন্তায় আজও তেমনভাবে প্রকাশিত হয় না। অথচ দেখতে দেখতে তাঁর বিশ্ববিজয় প্রচেষ্টার অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত হল— ১৩ অগস্ট ১৯৬৫ সোমবার দুপুরে প্রায় সত্তর বছরের এক বৃদ্ধ একটি ছাতা, দুটি ট্রাংক, এক কপি চৈতন্য চরিতামৃত, কিছু চিঁড়ে মুড়কি এবং সেই সঙ্গে আটটি ডলার এবং পাসপোর্ট-ভিসা ও পি-ফর্ম সম্বল করে একটি মিটার ট্যাক্সি চড়ে খিদিরপুর ডকের দিকে এগিয়ে চললেন, যাকে অবশ্যই মহানিষ্ক্রমণ বলা চলতে পারে। একজন গাইয়ে ভদ্রলোক দয়াপরবশ হয়ে তাঁর সঙ্গে খিদিরপুর পর্যন্ত এলেন, তাঁর নাম শিশির ভট্টাচার্য। জলযানের নাম জলদূত, সিন্ধিয়া কোম্পানির মালবাহী জাহাজ। যাত্রীর সঙ্গে রয়েছে একটা বিনামূল্যের টিকিট এবং সেই সঙ্গে জাহাজে বিনামূল্যে নিরামিষ খাওয়া-দাওয়ার অনুমতি।

সেদিন এই বঙ্গীয় বৃদ্ধের চোখে বিশ্ববিজয়ের স্বপ্ন, জাহাজ থেকে যখন তীরের দিকে তাকালেন তখন একজন অনুরাগীকেও বিদায় জানাতে দেখলেন না।

বহু বছর আগে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ যখন (১৮৯৩) বোম্বাই থেকে ভারত ত্যাগ করেছিলেন তখনও বন্দরে গুণগ্রাহীদের ভিড় না থাকলেও ছিলেন গুণগ্রাহী এক ভক্ত মহারাজের সেক্রেটারি, রাজার নির্দেশে তিনি সন্ন্যাসীর বিদেশযাত্রার গৈরিক বসন কিনে দিয়েছিলেন এবং সেইসঙ্গে একটা উঁচুক্লাসের টিকিট।

এর আগে নিচু ক্লাসের টিকিটের জন্য দক্ষিণের ভক্তরা প্রায় ভিক্ষে করে কিছু টাকা তুলেছিলেন, কিন্তু সেই সুযোগের সদ্বব্যবহার সম্ভব হয়নি স্বাস্থ্যের কারণে। পরবর্তী কালের অনুসন্ধান বলছে, পেটের রোগে বিব্রত সন্ন্যাসীকে ঘন ঘন টয়লেট যেতে হয় যা ডেকের যাত্রীর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। জাহাজ-চড়া সংগ্রামীর জীবনকথায় তার ইঙ্গিত রয়েছে, কৃতজ্ঞ সন্ন্যাসী জানাচ্ছেন, জাহাজের নতুন পরিবেশে তাঁর বাথরুমে ছোটাছুটি কমে গিয়েছে নাটকীয়ভাবে।

স্বামী বিবেকানন্দের সমুদ্রযাত্রার অনেক বিবরণ গত ১২৫ বছরে সংগৃহীত হয়েছে, কিন্তু অভয়চরণ দের কলকাতা থেকে ১৯৬৫ অগস্টে আমেরিকা যাত্রার ব্যাপারে আমরা তেমন কিছু জানি না।

কলকাতার এক সোনার বেনে পরিবারে অভয়চরণ দে’র জন্ম ১ সেপ্টেম্বর ১৮৯৬।

যতটুকু জানা যায় টালিগঞ্জে আদিগঙ্গাতীরে মাতুলালয়ে এক পর্ণকুটিরে কাঁঠাল গাছতলায় মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরেই মামা নাম দেন নন্দদুলাল।

মায়ের নাম রজনী, বাবা গৌরাঙ্গমোহন দে, এঁরা নবজাতকের নাম দেন অভয়চরণ। গৌরমোহনের ছিল উত্তর কলকাতায় কাপড়ের ব্যবসা, বসবাস ১৫১ হ্যারিসন রোডের এক তিন তলা বাড়িতে। প্রিয় পুত্রের আরও অনেকগুলো নাম দেওয়া হয়েছিল।

পিতৃদেব গৌরমোহন ছিলেন শুদ্ধ বৈষ্ণব, তিনি চেয়েছিলেন ছেলে হয়ে উঠুক কৃষ্ণভক্ত, যদিও মা চেয়েছিলেন তাঁর ছেলে বিলেত গিয়ে ব্যারিস্টার হোক।

এ বিষয়ে পিতৃদেবের প্রবল আপত্তি, কারণ বিদেশ গেলেই সে কোটপ্যান্ট পরবে, মদ খাবে এবং মেমসাহেবদের সঙ্গে মেলামেশা করবে। তিনি ছোট্ট ছেলেকে মৃদঙ্গ বাজানো শেখার ব্যবস্থা করলেন যাতে সে ভজন-কীর্তনে দক্ষ হয়ে উঠে শ্রীমদ্ভাগবতের বাণী প্রচার করতে পারে।

এদিকে একজন জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, জাতক সত্তর বছর বয়সে সাগরপাড়ি দিয়ে বিদেশে যাবেন, একজন বিখ্যাত ধর্মপ্রচারকরূপে স্বীকৃতি লাভ করবেন এবং ১০৮টি মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন।

নানা জন এই পুত্রের নানা নাম দিয়েছিলেন— মতি, নন্দু, বোচা। কচুরির প্রতি অস্বাভাবিক দুর্বলতার জন্য দিদিমা ডাকতেন কচুরি-মুখো।

শেষ পর্যন্ত মতিলাল শীল ফ্রি স্কুলে ঢুকলেন অভয়চরণ দে। তারও অনেক পরে সময়ের স্রোতে একসময় পুরো নাম হয়েছিল — কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়াচরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ। যে প্রতিষ্ঠানের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সারা বিশ্বে যার নাম ‘ইসকন’, বাংলায় আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ।

পরবর্তী কালে ভক্তিবেদান্ত তাঁর স্মৃতিচর্চাকালে বলেছেন, বাবার মাসিক রোজগার ছিল আড়াইশো টাকার মতো, তার থেকেও দেবসেবায় ব্যয় করতেন এবং ছেলেকে এক সময় স্কটিশচার্চ কলেজে দর্শন শাস্ত্রে বি এ অনার্স পড়তে পাঠান। সেখানে তাঁর এক বছরের সিনিয়র প্রেসিডেন্সি থেকে বিতাড়িত সুভাসচন্দ্র বসু।

বঙ্গজীবনে ক্রিশ্চান মিশনারি কলেজের ভূমিকা প্রসঙ্গে একটা জিনিস ইদানীং স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখানকার অনেক ছাত্র যেমন নিজেদের ধর্মে শ্রদ্ধা হারিয়ে স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়ে পরিবারের উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠেন, তেমন স্বামী পরমহংস বিবেকানন্দ, যোগানন্দ এবং ভক্তি-বেদান্ত এই তিনজনেই স্কটিশচার্চ কলেজের ছাত্র।

ঠাকুরের প্রিয় শিষ্য রামকৃষ্ণ মিশনের স্তম্ভস্বরূপ রামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গের অবিস্মরণীয় লেখক স্বামী সারদানন্দও ছিলেন আর এক মিশনারি কলেজ সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র। অর্থাৎ, সারা বিশ্বে ভারতীয় অধ্যাত্ম ভাবনা প্রচারে মিশনারি কলেজে শিক্ষিত ছাত্রদের দান অসীম। এ সম্বন্ধে কোনও সময়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ মন্দ হবে না, কিন্তু ভক্তিবেদান্তের বিস্ময়কর বিদেশযাত্রা এই মুহূর্তে আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, হ্যারিসন রোডের নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব বস্ত্রব্যবসায়ীর পুত্র শৈশব থেকে কীর্তনে আগ্রহী কৃষ্ণগতপ্রাণ বৈষ্ণব কী‌ভাবে বিশ্বপ্রচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার স্বপ্ন দেখলেন এবং কীভাবে সব বাধা অতিক্রম করে সত্তরোর্ধে তাঁর গুরুর ইচ্ছা পূরণ করলেন তার বিস্তারিত বিবরণ উপন্যাসকেও হার মানায়।

এই সুযোগে অভয়চরণের জীবনবৃত্তান্ত আরও একটু জেনে রাখা যেতে পারে। ছোটবেলায় তিনি একবার কঠিন অসুখে পড়েছিলেন। গৃহ-চিকিৎসক খ্যাতনামা ডাক্তার কার্তিক বসু চিকেন খাবার প্রেসক্রিপশন দিলেন, সেই সঙ্গে বললেন, তিনি নিজেই পথ্য তৈরি করে আনবেন।

সেই পথ্য মুখে দিয়েই শিশুর বমি শুরু হল, এই শরীরে আমিষ চলবে না তা বিখ্যাত ডাক্তার বুঝে গেলেন। পরবর্তী কালে ইসকনের নিরামিষ নীতির ইঙ্গিত পাওয়া গেল।

অভয়চরণ আজন্ম সন্ন্যাসী নন তাঁর বৈষ্ণবগুরু ভক্তিসিদ্ধান্তের মতন। সে কালের নিয়ম মতো কলেজে পড়তে পড়তেই ২২ বছর বয়সেই বিবাহ, কন্যার নাম রাধারানী দত্ত এবং পরবর্তী সময়ে পাঁচ পুত্র ও কন্যার পিতা।

এ দেশের অধ্যাত্মসাধনায় এটা নতুন কোনও ঘটনা নয়। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয় শিষ্য স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও স্বামী শিবানন্দ বিবাহিত জীবনের অভিজ্ঞতা পেরিয়ে সন্ন্যাসমন্ত্র লাভ করেছিলেন।

সংসার জীবনে অর্থ উপার্জনের প্রয়োজন এবং পিতৃদেবের প্রচেষ্টায় অভয়চরণ পারিবারিক বন্ধু ডাক্তার কার্তিক বসুর বিখ্যাত ওষুধ কোম্পানিতে।

মন দিয়েই সংসারধর্ম ও কাজকর্ম করছিলেন মেডিক্যাল সেলসম্যান অভয়চরণ, কিন্তু ১৯২২ সালে তাঁর বন্ধু নরেন্দ্র নাথ মিত্র অভয়চরণকে এক অদ্ভুত বৈষ্ণব সন্ন্যাসীর কাছে নিয়ে গেলেন।

বাগবাজারের গৌড়ীয় মঠে তিনি ভাবী গুরুকে প্রথম দেখলেন এবং প্রথম দর্শনেই ভক্তিভরে মাথানত করলেন। গুরু ভক্তসিদ্ধান্তের পিতাও আর একজন বৈষ্ণব চিন্তানায়ক, বহু গ্রন্থের রচয়িতা এবং একসময়ে পুরী জগন্নাথ মন্দিরের সুপারিনটিন্ডেন্ট।

পুরীতেই ভক্তিসিদ্ধান্তের জন্ম—সাত বছর বয়স থেকে ভগবৎগীতা কণ্ঠস্থ। এক সময় শতকোটিবার হরেকৃষ্ণমন্ত্র উচ্চারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ইনি দিনে একবার মাত্র অন্নগ্রহণ করতেন এবং ভূমিতে শয়ন করতেন। অভয়চরণ প্রথম দর্শনেই অভিভূত। ভাবীগুরু বললেন, ‘‘তোমরা শিক্ষিত ছেলে, চৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী সারা বিশ্বে প্রচার করো।’’

একজন হতাশা প্রকাশ করে বলল, ‘‘আপনার চৈতন্যবাণী কে শুনবে? আমরা পরপদানত ও পরাধীন, প্রথমে ভারত স্বাধীন হোক।’’

ভক্তিসিদ্ধান্তকে আরেকটি প্রশ্ন, ‘‘ইংরেজের অধীনে থাকলে আমরা নিজেদের সংস্কৃতি কী করে প্রচার করব?’’

স্মরণীয় কয়েকটি সাক্ষাৎকারে ভক্তিসিদ্ধান্ত তাঁর বৈপ্লবিক চিন্তার ইঙ্গিত দিলেন। তিনি ছাপাখানার মাধ্যমে বৈষ্ণবগ্রন্থের বিপুল প্রচারে বিশ্বাসী। নিজের মুদ্রণযন্ত্রের নামও দিয়েছিলেন ‘বিপুল মৃদঙ্গ’।

তাঁর বক্তব্য, কীর্তন আর কত দূর শোনা যায়? বৃহৎ মৃদঙ্গের সাহায্যে চৈতন্যদেবের বাণী শোনা যাবে সারা বিশ্বে।

যথাসময়ে অভয়চরণ জানলেন, বৃহন্নারদীয় পুরাণ এবং উপনিষদ থেকে সঞ্চয়িত মন্ত্র :

হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ

কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে

হরে রাম, হরে রাম

রাম রাম, হরে হরে।

অভয়চরণ তখন যথেষ্ট ভক্তি ও যথেষ্ট উপার্জনের দ্বৈতপথে যাতায়াত করছেন। তাঁর ইচ্ছা, বিজনেস থেকে প্রভূত উপার্জন হলে তিনি ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতীর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে অর্থসাহায্য করবেন। এই সময় একজন জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, অভয়চরণ এক দিন ভারতবর্ষের অন্যতম ধনবান হবেন।

অতএব ব্যবসায়ের বিস্তার প্রয়োজন। ডাক্তার বসুর সঙ্গে কিছু কথা হল। তিনি বললেন, অভয় উত্তর ভারতে তাঁর কোম্পানির এজেন্ট হতে পারেন।

অভয় সপরিবার চলে এলেন ইলাহাবাদে। সেখানে কলকাতার কোম্পানির এজেন্সি ছাড়াও নিজের তৈরি ওষুধও বিক্রি হবে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত নতুন প্রতিষ্ঠানের নাম প্রয়াগ ফার্মাসি। সেখানে একজন ডাক্তারের সঙ্গে পার্টনারশিপ হল। তিনি জনস্টনগঞ্জের দোকানে বসে রোগী দেখবেন, প্রেসক্রিপশন লিখবেন এবং সেই প্রেসক্রিপশনের দামের পঁচিশ পার্সেন্ট কমিশন পাবেন।

এক সময় প্রয়াগ ফার্মাসির নাম ছড়িয়ে পড়ল। স্বয়ং মতিলাল নেহরু ও জওহরলাল তাঁর খরিদ্দার ছিলেন এবং অভয়চরণ আট হাজার টাকায় একখানা সেকেন্ডহ্যান্ড বুইক গাড়ি কিনে ফেললেন। এই গাড়ি ট্যাক্সি হিসেবেও খাটানো হত।

এই প্রয়াগেই পিতৃদেব গৌরমোহনের দেহাবসান হল। শেষনিঃশ্বাস ত্যাগের আগে ছেলেকে তিনি বললেন, বাড়ির গরু ও বাছুরটি স্থানীয় বৈষ্ণব মঠকে দিও এবং মঠের লোকরা যেন কীর্তন করতে করতে তাঁর মরদেহ শ্মশানে নিয়ে যায়।

গুরু ভক্তিসিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে তাঁর প্রচারকর্ম অব্যাহত রেখেছেন। তাঁর ছাপাখানার সংখ্যা ১৯৩২-এ তিন, সেখান থেকে ছ’টি সাময়িকপত্র ছাপা হচ্ছে। এক সময় ‘নদিয়া প্রকাশ’ বলে দৈনিকপত্র প্রকাশের কথাও ভেবেছেন। একই বছরে তিনি শতসঙ্গী নিয়ে বৃন্দাবন পরিক্রমায় এলেন। পাঁচ হাজার বছর আগে শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনের যে সব অংশ পদব্রজে পরিক্রমা করেছিলেন, সেই সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন।

বিদেশে ভক্তবেষ্টিত স্বামী প্রভুপাদ

বিদেশে ভক্তবেষ্টিত স্বামী প্রভুপাদ

আরও পরে প্রয়াগের এক অনুষ্ঠানে ভক্তিসিদ্ধান্ত তাঁর প্রিয় অভয়কে দীক্ষা দিলেন। তাঁর নতুন নাম হল অভয়াচরণারবিন্দ। ইলাহাবাদ ছাড়বার আগে গুরু নির্দেশ দিলেন রূপ গোস্বামী রচিত ভক্তি-রসামৃত-সিন্ধু মন দিয়ে পড়তে হবে। গুরুর সঙ্গে অভয়ের যোগাযোগ ক্রমশ নিবিড় হতে লাগল এবং তিনি এক সময় চিঠিতে শিষ্যকে জানালেন, তুমি ইংরিজিতে ভাল প্রচারক হতে পারো, এতে মানুষের মঙ্গল হবে। অভয়চরণ তখনও ভাবছেন বিজনেসকে বিস্তৃত করে আরও উপার্জনের কথা। আর গুরু বলছেন, যদি কখনও টাকা পাও তাহলে কিছু বই ছেপো। গুরু ভক্তিসিদ্ধান্তের দেহাবসান ১৯৩৭ সালের ১ জানুযারি—তার আগে শিষ্যের কাছে বারবার আবেদন, ইংরিজিটার ওপর জোর দাও, অনুবাদে মন দাও, বই ছাপো, না হলে সারা বিশ্বে প্রচার সম্ভব হবে না।

ইতিমধ্যে ব্যবসায়িক সাফল্যের সন্ধানে  অভয়চরণ কখনও কানপুরে, কখনও বোম্বাইতে এবং অবশেষে কলকাতায়। সেখানকার ঠিকানা ৬ নম্বর সীতাকান্ত ব্যানার্জি লেন, কোম্পানির নাম অভয়চরণ দে অ্যান্ড সন্স, সেই সঙ্গে বাত-বেদনা থেকে মুক্তির মালিশ দে’জ পেইন লিনিমেন্ট!

১৯৩৮-৩৯-এর কথা। অভয়চরণ পরের বছর ইংরিজিতে বই লিখলেন ইনট্রোডাকশন টু গীতোপনিষদ। পরিচিতজনরা তাঁকে ‘ভক্তিসিদ্ধান্ত’ টাইটেল দিতে চাইলেন। কিন্তু তিনি গুরুর নাম নিলেন না, অবশেষে পছন্দ করলেন ‘ভক্তিবেদান্ত’।

এ সব মহাযুদ্ধের আগের কথা। এই সময়য়েই পরবর্তী কালে বিশ্ববিখ্যাত ইংরিজি সাময়িকপত্র ‘ব্যাক টু গড্ হেড্’ প্রকাশ। যুদ্ধের পর ভাগ্যসন্ধানে কলকাতার ব্যবসা তুলে দিয়ে ৬০০ মাইল দূরে লখনউতে চল্লিশ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে অভয়চরণ ওষুধের কারখানা খুললেন। কিন্তু তা চলল না। তিন বছর পরে অভয়চরণ আবার ইলাহাবাদে ফিরে এলেন। সেখান থেকে আবার কলকাতায়, বসবাস চেতলায়।

আবার নতুন সব ভাবনা। ভারতীয় ধারা অনুযায়ী বিশ বছর পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য, একুশ বছর গার্হস্থ্য, একান্ন বছরে বানপ্রস্থ।

১৯৫৪ সালে ৫৮ বছর বয়সে অভয়চরণ সংসার থেকে বেরিয়ে আসেন এবং পাঁচ বছর পর ৬৩ বছর বয়সে মথুরায় কেশব মহারাজের কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন।

ইতিমধ্যেই নানা পথ ঘুরে বৃন্দাবনের সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো রাধারমণ মন্দিরে ছোট্ট একটি ঘরে আশ্রয়লাভ। বিনামূল্যে নয়, মাসিক ভাড়া পাঁচ টাকা।

ছোট্ট এইটুকু ঘরে গুরুর ইচ্ছাপূরণের জন্য শ্রীমদ্ভাগবতমের ইংরিজি অনুবাদের ম্যারাথন যাত্রা শুরু। আকারে বিশাল এই বই, কাজের সুবিধার জন্যে অভয়চরণ একটি পোর্টেবল টাইপরাইটার সংগ্রহ করলেন। খণ্ডে খণ্ডে এই বই প্রকাশ একজন মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব, কিন্তু গুরুর স্বপ্নকে সম্ভব করে তুলবার জন্য দুঃসাহসী শিষ্য সম্পূর্ণ তৈরি।

অভয়চরণ একসময় ভাবলেন, অনুবাদের কাজ শেষ করে তার পর মুদ্রণের চেষ্টা করলে ভাল হবে না, তার থেকে ধৈর্য ধরে এক একটা খণ্ড প্রকাশ করো, বিক্রি করো, তারপর আবার ছাপো।

এই অবিশ্বাস্য প্রচেষ্টার শুরু বৃন্দাবনে, ছাপাবার জন্যে যাতায়াত দিল্লিতে। দিল্লিতে থাকার কোনও জায়গা নেই, তাই ওখানকার কাজ শেষ করে প্রতিদিন আবার বৃন্দাবনে ফিরে আসা।

চলমান…